সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বল্পপ্রাণ স্থূলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহংকার। তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ । ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার- এ সবের নিশান ওড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানবপ্রেমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় আন্তরিকতাশূন্য, উপলব্ধিহীন বুলি ।
এদের স্থানে এনে দিতে হবে বড় মানুষ— সূক্ষ্মবুদ্ধি উদারহৃদয় গভীরচিত্ত ব্যক্তি, যাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে জীবনের বিকাশ, কেবল টিকে থাকা নয়। তাদের কাছে জীবনাদর্শের প্রতীক হবে প্রাণহীন ছাঁচ বা কল নয়, গতি আছে, সজীব বৃক্ষ— যার বৃদ্ধি আছে, বিকাশ আছে, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে অপরের সেবার জন্য প্রস্তুত হওয়া যার কাজ । বৃক্ষের জীবনের গতি ও বিকাশকে উপলব্ধি করা দরকার, নইলে সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার ছবি চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না ।
বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন । মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয় । তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অন্য কথা বলেছেন। ফুলের ফোটা আর নদীর গতির সঙ্গে তুলনা করে তিনি নদীর গতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মনে মনুষ্যত্বের বেদনা নদীর গতিতেই উপলব্ধ হয়, ফুলের ফোটায় নয় । ফুলের ফোটা সহজ, নদীর গতি সহজ নয়— তাকে অনেক বাধা ডিঙানোর দুঃখ পেতে হয়। কিন্তু ফুলের ফোটার দিকে না তাকিয়ে বৃক্ষের ফুল ফোটানোর দিকে তাকালে বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ভালো করতেন। তপোবনপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কেন যে তা করলেন না বোঝা মুশকিল ।
জানি, বলা হবে : নদীর গতিতে মনুষ্যত্বের দুঃখ যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৃক্ষের ফুল ফোটানোয় তা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না । তাই কবি নদীকেই মনুষ্যত্বের প্রতীক করতে চেয়েছেন ।উত্তরে বলব : চর্মচক্ষুকে বড় না করে কল্পনা ও অনুভূতির চক্ষুকে বড় করে তুললে বৃক্ষের বেদনাও সহজে উপলব্ধি করা যায়। আর বৃক্ষের সাধনায় যেমন একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, মানুষের সাধনায়ও তেমনি একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, আর এটাই হওয়া উচিত নয় কি? অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয় । যাকে বলা হয় গোপন ও নীরব সাধনা তা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত, নদীতে নয় । তাছাড়া বৃক্ষের সার্থকতার ছবি যত সহজে উপলব্ধি করতে পারি, নদীর সার্থকতার ছবি তত সহজে উপলব্ধি করা যায় না। নদী সাগরে পতিত হয় সত্য, কিন্তু তার ছবি আমরা প্রত্যহ দেখতে পাই না । বৃক্ষের ফুল ফোটানো ও ফল ধরানোর ছবি কিন্তু প্রত্যহ চোখে পড়ে । দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে সে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে ।
সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস । নদীর সাগরে পতিত হওয়ায় সেই প্রাপ্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। সে তো প্রাপ্তি নয়, আত্মবিসর্জন। অপরপক্ষে বৃক্ষের প্রাপ্তি চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। ফুলে ফলে যখন সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন আপনা থেকেই বলতে ইচ্ছা হয় : এই তো সাধনার সার্থকতা। বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান । সৃজনশীল মানুষেরও প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য দেখা যায় না। যা তার প্রাপ্তি তা-ই তার দান ।
বৃক্ষের পানে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই অন্তরের সৃষ্টিধর্ম উপলব্ধি করেছেন । বহু কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু গদ্যে তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি। বললে ভালো হতো। তাহলে নিজের ঘরের কাছেই যে সার্থকতার প্রতীক রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমরা সচেতন হতে পারতাম ।
নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায়। অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে। তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই। প্রকৃতির যে ধর্ম মানুষের সে ধর্ম; পার্থক্য কেবল তরুলতা ও জীবজন্তুর বৃদ্ধির ওপর তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, মানুষের বৃদ্ধির ওপরে তার নিজের হাত রয়েছে। আর এখানেই মানুষের মর্যাদা । মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও । মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়, তা তৈরি পাওয়া যায় না। সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের যে পরিপক্বতা, তাই তো আত্মা । এই আত্মারূপ ফল স্রষ্টার উপভোগ্য । তাই মহাকবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় : ‘Ripeness is all’- পরিপক্বতাই সব। আত্মাকে মধুর ও পুষ্ট করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে তা স্রষ্টার উপভোগের উপযুক্ত হবে না। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রচুর প্রেম ও গভীর অনুভূতির দ্বারা আত্মার পরিপুষ্টি ও মাধুর্য সম্পাদন সম্ভব। তাই তাদের সাধনাই মানুষের শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু। বস্তুজিজ্ঞাসা তথা বিজ্ঞান কখনো শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না। কেননা, তাতে আত্মার উন্নতি হয় না- জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয় না; তা হয় সাহিত্য-শিল্পকলার দ্বারা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এত মূল্য।
ওপরে যে বৃদ্ধির কথা বলা হলো বৃক্ষের জীবন তার চমৎকার নিদর্শন। বৃক্ষের অঙ্কুরিত হওয়া থেকে ফলবান হওয়া পর্যন্ত সেখানে কেবলই বৃদ্ধির ইতিহাস। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা লাভবান হতে পারি— জীবনের গূঢ় অর্থ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি বলে।
বৃক্ষ যে কেবল বৃদ্ধির ইশারা তা নয়- প্রশান্তিরও ইঙ্গিত। অতি শান্ত ও সহিষ্ণুতায় সে জীবনের গুরুভার বহন করে।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুরে। তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' নামে পরিচিত বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির এক যুগান্তকারী আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি হিসেবে। সাহিত্যের অঙ্গনে ও বাস্তব জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সৌন্দর্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি-চেতনা ও মানবপ্রেমের আদর্শের অনুসারী । তিনি ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখের সহযোগী। মননশীল, চিন্তা-উদ্দীপক ও পরিশীলিত গদ্যের রচয়িতা হিসেবে বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন। তাঁর গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি কথা' বাংলাদেশের প্রবন্ধ-সাহিত্যে এক বিশিষ্ট সংযোজন । তাঁর প্রকাশিত অন্য দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ক্লাইভ বেল-এর 'Civilization' গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত ‘সভ্যতা' এবং বারট্রান্ড রাসেলের 'Conquest of Happiness' গ্রন্থের অনুবাদ ‘সুখ'। বাংলা একাডেমি তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা রচনাবলি-আকারে প্রকাশ করেছে। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনাকালে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্থুলবুদ্ধি - সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিহীন। অগভীর জ্ঞানসম্পন্ন।
জবরদস্তিপ্রিয় - গায়ের জোরে কাজ হাসিলে তৎপর। বিচার-বিবেচনাহীন।
বিকৃতবুদ্ধি - বুদ্ধির বিকার ঘটেছে এমন। যথাযথ চিন্তাচেতনাহীন।
এদের প্রধান দেবতা অহংকার - যথাযথ বিচার-বিবেচনা ও চিন্তাচেতনাহীন লোকেরা এত গর্বোদ্ধত হয়ে থাকে যে মনে হয় যেন অহংকারই তাদের প্রধান উপাস্য বা দেবতা ।
বুলি - এখানে গৎ-বাঁধা কথা হিসেবে ব্যবহৃত। যথাযথ অর্থ বহন করে না এমন কথা যা অভ্যাসের বশে বলা হয়ে থাকে।
মনুষ্যত্ব - মানবোচিত সদগুণাবলি। মানুষের বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য ।
তবোপন-প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ - প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন অরণ্য ও বৃক্ষপ্রেমিক । তাঁর অনেক কবিতায় বৃক্ষের বন্দনা স্পষ্ট।
তপোবন - অরণ্যে ঋষির আশ্রম। মুনি ঋষিরা তপস্যা করেন এমন বন।
অনুভূতির চক্ষু - মনের চোখ। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভূতির বা উপলব্ধির ক্ষমতা, সংবেদনশীলতা।
নতি - অবনত ভাব। বিনয়, নম্রতা।
বৃক্ষের প্রাপ্তি ও দান - বৃক্ষের অর্জন হচ্ছে তার ফুল ও ফল । এগুলো সে অন্যের হাতে তুলে দেয় ।
ফলে বৃক্ষ যুগপৎ প্রাপ্তি ও দানের আদর্শ।
সৃষ্টিধর্ম - সৃষ্টি বা সৃজনের বৈশিষ্ট্য।
আত্মিক - মনোজাগতিক। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্র।
পরিপক্বতা - সুপরিণতিজাত। পরিপূর্ণ বিকাশসাধন ।
বস্তু জিজ্ঞাসা - বস্তুজগতের রহস্য উন্মোচন-অন্বেষা। বস্তুজগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ।
গূঢ় অর্থ - প্রচ্ছন্ন গভীর তাৎপর্য ।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর “জীবন ও বৃক্ষ” প্রবন্ধটি তাঁর ‘সংস্কৃতি কথা' গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। পরার্থে আত্মনিবেদিত সুকৃতিময় সার্থক বিবেকবোধসম্পন্ন মানবজীবনের মহত্তম প্রত্যাশা থেকে লেখক মানুষের জীবনকাঠামোকে তুলনা করেছেন বৃক্ষের সঙ্গে। তিনি দেখিয়েছেন, বৃক্ষের বিকাশ, পরিপূর্ণতা ও সার্থকতার পেছনে রয়েছে তার নীরব সাধনা। বৃক্ষ যেমন করে ফুলে ফলে পরিপূর্ণতা পায়, আর সে সব অন্যকে দান করে সার্থকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, মানব-জীবনের সার্থকতার জন্য তার নিজের সাধনাও তেমনি হওয়া উচিত । তাহলেই স্বার্থপর, অহংকারী, বিবেকহীন, নিষ্ঠুর জবরদস্তিপ্রবণ মানুষের জায়গায় দেখা দেবে প্রেমে, সৌন্দর্যে, সেবায় বিকশিত বিবেকবান পরিপূর্ণ ও সার্থক মানুষ ৷
আরও দেখুন...